সৌরজগতে আটটি গ্রহের মধ্যে সূর্যের সবচেয়ে নিকটে রয়েছে বুধ, তারপর রয়েছে শুক্র এবং এরপর পৃথিবী। অর্থাৎ সৌরজগতের তৃতীয় গ্রহ হল আমাদের পৃথিবী। আয়তনে পৃথিবী সৌরজগতের পঞ্চম বৃহত্তম গ্রহ। আবার ভরের দিক দিয়ে পৃথিবী সৌরজগতের ষষ্ঠ গ্রহ।
পৃথিবীর ভর কত?
পৃথিবীর ভর 5.972 x 10 ^ 24 কেজি বা প্রায় 6,000,000,000,000,000,000,000,000 কেজি। এত বড় একটি সংখ্যা আমরা বুঝতে পারলেও অনুমান করা কিন্তু খুবই কঠিন যে এই ভর কতটা বেশি। চলুন পৃথিবীর ভর কে বিভিন্ন এককে রূপান্তরিত করে দেখা যাক।
পৃথিবীর ভর
= 6,000,000,000,000,000,000,000,000 কেজি
বা, ৬ ট্রিলিয়ন-ট্রিলিয়ন কিলোগ্রাম
= 6,000,000,000,000,000,000,000 মেট্রিক টন
= 6,000,000,000,000,000 মেগা টন
= 6,000,000,000,000 গিগা টন
কিভাবে পৃথিবীর ভর পরিমাপ করা হয়েছে?
স্বাভাবিকভাবে আমাদের মধ্যে পৃথিবীর ভর পরিমাপ করা নিয়ে অসংখ্য প্রশ্ন ও দ্বিধার জন্ম হয়। আমরা ভাবি কিভাবে এই বৃহৎ গ্রহটির ভর পরিমাপ করা হল। অবশ্যই অন্যান্য বস্তু পরিমাপের মত দাড়ি পাল্লা ব্যাবহার করে তো আর সম্ভব না। তাহলে কিভাবে নির্ণয় করা হয়েছে পৃথিবীর ভর?
যে ব্যক্তিকে পৃথিবীর ভর পরিমাপ করার কৃতিত্ব দেওয়া হয় তিনি হলেন হেনরি ক্যাভেন্ডিস (1731-1810)। তবে এক্ষেত্রে যার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তিনি হলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা পদার্থবিজ্ঞানী - স্যার আইজ্যাক নিউটন (1642-1727)।
পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন সূত্রের মধ্যে সার্বজনীন মহাকর্ষ সূত্র হতে আমরা জানি, মহাবিশ্বের যে কোন দুটি বস্তু পরস্পরকে একে অপরের দিকে আকর্ষণ করে। এই আকর্ষণ বল বস্তুদ্বয়ের ভরের সমানুপাতিক এবং দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক। সূত্রটির গাণিতিক রূপ হল:
F = Gm1m2/d^2
যেখানে, F হল বস্তুদ্বয়ের আকর্ষণ বল m1, m2 বস্তুদ্বয়ের ভর এবং d হল বস্তুদ্বয়ের মধ্যবর্তী দূরত্ব।
১৭৯৮ সালে ক্যাভেন্ডিস এই সূত্রটি ব্যাবহারের মাধ্যমেই পৃথিবীর ভর নির্ণয়ে সমর্থ হয়েছিলেন।
ক্যাভেন্ডিস একটি টরশন ভারসাম্য যন্ত্রে (নিচের চিত্র) সীসা গোলকের আকর্ষণ বল পরিমাপ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু দুটি ছোট ধাতব গোলকের মধ্যে ক্ষুদ্রা-কর্ষণ মহাকর্ষ পরিমাপ করার জন্য এই যন্ত্রটি অপ্রতুল ছিল। তাই ক্যাভেন্ডিস পরীক্ষাটির জন্য একটি নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
টরসনের ভারসাম্য যন্ত্র | Image by Dreamstime |
তিনি একটি বিশাল ডাম্বেল তৈরি করেছিলেন,যাতে দুই ইঞ্চির দুটি সীসার গোলক ছয় ফুট দীর্ঘ কাঠের দুই প্রান্তে আটকানো ছিল। ডাম্বেলটি একটি দড়ির সাহায্যে কেন্দ্র বরাবর ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল যাতে ডাম্বেলটি মুক্তভাবে ঘুরতে পারে।
এরপর তিনি আরও একটি ডাম্বেল নিয়েছিলেন যাতে কিনা দুটি ১২ ইঞ্চির সীসার গোলক যুক্ত ছিল এবং প্রত্যেকটি গোলকের ভর ছিল ৩৫০ পাউন্ড। এরপর এই বড় ডাম্বেলটিকে তিনি ছোট ডাম্বেলের কাছে নিচের চিত্রের মত করে স্থাপন করেছিলেন। নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রানুসারে বড় গোলক গুলোর আকৃতি ও ভর বেশি হওয়ার কারণে তারা ছোট গোলক দুটিকে আকর্ষণ করবে ফলে ছোট ডাম্বেলটিতে একটি গতি ভ্রামক সৃষ্টি হবে।
ক্যাভেন্ডিস এর পরিক্ষা । ক্ষুদ্র গোলকের সরণ |
ক্যাভেন্ডিস এভাবে যন্ত্র স্থাপন করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন।
যেহেতু তিনি গোলক সমূহের ভর এবং তাদের মধ্যবর্তী দূরত্ব জানতেন তাই খুব সতর্কতার সাথে তিনি গোলকের সরণ পর্যবেক্ষণ করে ছোট গোলকদ্বয়ের উপর বড় গোলকদ্বয়ের আকর্ষণ বল গাণিতিকভাবে নির্ণয় করেন। এবার এই আকর্ষণ বলের মান থেকে তিনি নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রের মাধ্যমে মহাকর্ষীয় ধ্রুবক G এর মান নির্ণয় করেন।
এবার F = mg সূত্রের মাধ্যমে গোলক দুটির ওজন বের করলে গোলকদ্বয়ের উপর পৃথিবীর আকর্ষণ বল বের হবে। যেহেতু গোলকদ্বয়ের ঘনত্ব জানা ছিল, দুই বলের তুলনা থেকে তিনি পৃথিবীর ঘনত্ব বের করেছিলেন।
ত্রুটি এড়ানোর জন্য তিনি যন্ত্রদ্বদয়কে বিভিন্ন ভাবে ঘুড়িয়ে পরীক্ষাটি করেছেন এবং প্রতিক্ষেত্রে সূক্ষ্মভাবে পাঠ নিয়েছেন। প্রতিটি সম্ভাব্য জটিল ত্রুটি চিহ্নিত করার পরে, ক্যাভেন্ডিস সেসব ত্রুটি সংশোধন করেছেন এবং শেষ অবধি ১৯৯৮ সালের জুনে রয়্যাল সোসাইটি তে "পৃথিবীর ঘনত্ব নির্ধারণের জন্য এক্সপেরিমেন্টস" শীর্ষক একটি ৫৭-পৃষ্ঠার গবেষণাপত্রে তার ফলাফল জানিয়েছিলেন। তিনি জানিয়েছেন যে পৃথিবীর ঘনত্ব পানির ঘনত্বের ৫.৪৮ গুণ (বর্তমানে গৃহীত মান ৫.৫২)।
বুঝতেই পারছেন, কোন বস্তুর ঘনত্ব জানা থাকলে তার ভর বের করাও সম্ভব। সৌভাগ্যবশত এই ঘটনার অনেক আগেই পৃথিবীর ব্যাসার্ধ নির্ণীত হয়েছিল। তাই ব্যাসার্ধ থেকে আয়তন বের করে "ঘনত্ব = ভর/আয়তন" সূত্র ব্যাবহার করে সহজেই পৃথিবীর ভর বের করা সম্ভব হয়েছিল।
আরও একটি পদ্ধতি অবলম্বন করে পৃথিবীর ভর বের করা হয়েছিল। তবে এ ক্ষেত্রেও নিউটনের সূত্রই ব্যাবহার করা হয়েছিল। নিউটনের সময়ে মানুষ জ্যামিতি ব্যাবহার করে পৃথিবী থেকে চাদের দূরত্ব নির্ণয় করতে শিখেছিল। আর পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে চাদের কত সময় লাগত তা চন্দ্রমাসের মাধ্যমেই জানা যেত। এসব তথ্যের সাহায্যে নিউটনের Me = (4 π^2 d^3 / G T^2) সূত্র ব্যাবহার করে পৃথিবীর ভর সেই একই রকম পাওয়া গিয়েছিল।
এভাবেই কোন রকম ওজন করার মত ঝামেলা ছারাও শুধুমাত্র গাণিতিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব যে কোন গ্রহ নক্ষত্রের ভর ঠিক যেমন করে নির্ণয় করা হয়েছিল পৃথিবীর ভর।
কমেন্ট বক্সে লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত জানান |
0 মন্তব্যসমূহ
If it seems any informative mistake in the post, you are cordially welcome to suggest fixing it.