পৃথিবীর ঘূর্ণন | Image Source: lumenlearning |
পৃথিবী সূর্যের চারদিকে উপবৃত্তাকার পথে অবিরত ঘুরছে। আবার এই ঘূর্ণনের সময় পৃথিবী নিজের অক্ষেও সমবেগে ঘুরছে।
পৃথিবীর এমন ঘূর্ণন কে বিজ্ঞানীরা লাটিমের ঘূর্ণনের সাথে তুলনা করে থাকেন। লাটিম যেমন তার কাটার উপর বনবন করে ঘুরতে থাকে এবং সেই সাথে মাটির উপরেও চক্রাকারে আবর্তন করে, পৃথিবীও ঠিক একইভাবে ঘোরে। পার্থক্য শুধু লাটিম ঘুরতে ঘুরতে ঘর্ষণ বলের কারণে ধীরে ধীরে থেমে যায় কিন্তু মহাশূন্যে কোন ঘর্ষণ বল না থাকায় পৃথিবী সমবেগে সর্বদা ঘুরতে থাকে।
বিজ্ঞানীদের হিসাব অনুযায়ী, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে প্রায় ৩০ কি.মি./সেকেন্ড বা ১,০৭,৮২৬ কি.মি/ ঘণ্টা বা ৬৭,০০০ মাইল/ঘণ্টা বেগে ঘুরছে। সেই সাথে নিজ অক্ষে পৃথিবীর ঘূর্ণন বেগ প্রায় ৪৬০ মি./সেকেন্ড বা ১,৬০০ কি.মি./ ঘণ্টা বা ১,০০০ মাইল/ ঘণ্টা।
বোঝাই যাচ্ছে পৃথিবীর ঘূর্ণন বেগ কত বেশি।
আর পৃথিবীর এমন বেগ আমাদের মনে সবচেয়ে যে প্রশ্নের জন্ম দেয় তা হল এত বেগে ঘোরার কারণেও পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে আমরা বাইরের দিকে ছিটকে পড়ে যাই না কেন এবং কেনই বা আমরা এই প্রচণ্ড বেগ অনুভব করতে পারি না!
সত্যিই তো, স্বাভাবিক ভাবে আপনি যদি ঘূর্ণায়মান যে কোন বস্তুর উপর নিজেকে কল্পনা করেন তাহলে প্রথমেই আপনার মাথায় বস্তুটি থেকে ছিটকে পড়ে যাওয়ার ব্যাপারটি চলে আসবে। তাহলে পৃথিবীর ক্ষেত্রে কেন এটা হচ্ছে না?
কোন বস্তু ঘুরতে থাকলে আমরা এভাবেই বাইরের দিকে ছিটকে যাই । Image source Internet |
পৃথিবীর ঘূর্ণনে আমরা ছিটকে পড়ে যাই না বা এই প্রচণ্ড বেগ অনুভব করতে পারি না মূলত বিশেষ কিছু কারণে। চলুন কারণগুলো দেখে নেওয়া যাক।
কারণঃ ১
প্রথমত, পৃথিবীর সাথে সাথে এর পৃষ্ঠে অবস্থিত সবকিছু এমনকি বায়ুমণ্ডলও একই বেগে ঘুরছে। যেহেতু পৃথিবী পৃষ্ঠে অবস্থিত গাছপালা, ঘরবাড়ি, স্থাপনা, মানুষ বা পশুপাখি সবকিছুই পৃথিবী পৃষ্ঠের সাথে সংযুক্ত, সেহেতু সবকিছুই একই বেগে গতিশীল।
তবে বায়ুমণ্ডলের কথা আমাদের বিশেষভাবে বলতে হবে, কারণ যে কোন গতিই বোঝার জন্য আমাদের ঘর্ষণ বল অনুভব করতে হবে। যেমন, আপনি যদি মাঠে বা কোন খোলা জায়গায় দৌড় দেন তাহলে বাতাসের বাধা অনুভব করতে পারবেন। কারণ তখন বায়ুমণ্ডল আপনার সাথে একই দিকে বা একই বেগে গতিশীল না। ফলে আপনার গতির বিপরীত দিকে বাতাসের এক প্রবল বাধা অনুভব করবেন। আর ঘর্ষণ বল সবসময় গতির বিপরীত দিকে কাজ করে।
দৌড়ানোর সময় আমরা বাতাসে বাঁধা অনুভব করি | Image: Internet |
কিন্তু পৃথিবীর সাথে সাথে আমাদের বায়ুমণ্ডলও একই বেগে একই দিকে ঘুরছে, ফলে আমরা পৃথিবীর ঘূর্ণন বেগের কারণে কোন প্রকার বাধার সম্মুখীন হচ্ছি না।
বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর চারদিকে এক গ্যাসীয় স্তর তৈরি করে রেখেছে। এই স্তর পৃথিবীর সমান বেগে গতিশীল থাকার কারণে আমরা কোন বাধার সম্মুখীন হচ্ছি না, অর্থাৎ কোন প্রকার ঘর্ষণ বল আমাদের উপর কাজ করছে না। এতে করে আমরা পৃথিবীর ঘূর্ণনকে অনুভব করতে পারি না।
কারনঃ ২
সবচেয়ে বড় যে কারণটি তা হল পৃথিবীর অভিকর্ষ বল। পৃথিবী যে বল দ্বারা তার পৃষ্ঠে অবস্থিত সকল বস্তুকে নিজ কেন্দ্রের দিকে আকর্ষণ করে তাকে অভিকর্ষ বল বলে। অর্থাৎ পৃথিবী আমাদেরকে তার কেন্দ্রের দিকে আকর্ষন করে।
আবার ঘূর্ণায়মান বস্তুর কেন্দ্রের বাইরের দিকে একটি বল তৈরি হয়, যাকে কেন্দ্রবিমুখী বল বলে। যেমন আপনি যদি একটি ছোট পাথরের টুকরো কে দড়ি দিয়ে বেঁধে দড়ির অন্যপ্রান্ত ধরে বৃত্তাকারে ঘুরাতে থাকেন তাহলে আপনার হাতে একট টান অনুভব করবেন। এই টানটিই কেন্দ্রবিমুখী বল।
কেন্দ্রবিমুখী বলের উদাহরণ | Image Source: Stable blow |
পৃথিবী যেহেতু ঘুরছে আমাদেরও পৃথিবী পৃষ্ঠের বাইরের দিকে এই বল অনুভব করার কথা। মূলত এই বলের কারণে আমাদের বাইরের দিকে ছিটকে পড়ার কথা। কিন্তু ঘূর্ণনের কারণে পৃথিবী পৃষ্ঠে অবস্থিত কোন বস্তু পৃথিবী পৃষ্ঠের বাইরের দিকে যে বল অনুভব করে তা অভিকর্ষ বলের তুলনায় খুবই নগণ্য। তাই পৃথিবী যতই ঘুরুক না কেন, অভিকর্ষ বলের প্রভাবে আমরা ঠিকই পৃথিবী পৃষ্ঠে আটকে থাকি।
কারণঃ ৩
পৃথিবী সর্বদা সমবেগে গতিশীল। অর্থাৎ এর বেগ বাড়ছেও না আবার কমছেও না। কোন বস্তু যখন সমবেগে গতিশীল থাকে তখন আমরা ওই বস্তুটির বেগ অনুভব করতে পারি না।
যেমন ধরুন আপনি যখন লিফটে করে উপরে ওঠেন বা নিচে নামেন তখন লিফট চালু হওয়ার বা থেমে যাওয়ার মূহুর্তে আপনি অনুভব করতে পারেন যে লিফটটি উপরে উঠছে বা নিচে নামছে। কারণ তখন বেগের পরিবর্তন হয়। কিন্তু লিফটটি চালু হওয়ার একটু পরেই আপনি আর লিফটের বেগ অনুভব করতে পারবেন না। কারণ তখন লিফটটি একটি নির্দিষ্ট বেগে গতিশীল থাকে। ঘটনাটি বিশ্বাস না হলে লিফট চালু হওয়ার একটু পর আপনার চোখ বন্ধ করে পরিক্ষা টি করতে পারেন। দেখুন তো বুঝতে পারেন কি না যে উপরে উঠছেন নাকি নিচে নামছেন? (চোখ বন্ধ করতে বলছি কারণ তাকিয়ে থাকলে পরিপার্শ্বের সাপেক্ষে আমরা কোন দিকে যাচ্ছি সে সম্পর্কে মস্তিষ্ক সচেতন থাকে)।
গাড়িতে চলার সময়ও একই ঘটনা ঘটে। গাড়ি যখন সমবেগে চলে তখন আমরা বেগ অনুভব করি না। ফলে গাড়ির সিটে আমরা স্থির ভাবে বসে থাকতে পারি। কিন্তু যখনই গাড়ির গতি বাড়ে কিংবা ব্রেক কষে গতি কমিয়ে দেওয়া হয় তখন আমরা স্থির বসে থাকতে পারি না। সামনে বা পিছনের দিকে একটা ঝোঁক অনুভব করি।
বামেঃ গাড়ি যখন সমবেগে চলে; ডানেঃগাড়ি যখন ব্রেক করে (বেগের পরিবর্তন) |
এই একই কারণে আমরা পৃথিবীর ঘূর্ণন বেগ বুঝতে পারি না। এর বেগ সর্বদা সমান থাকে। ভূ-পৃষ্ঠের প্রতিটি স্থানের এই আবর্তন বেগ সমান হওয়ার দরুন এমন গতিশীল অবস্থা আমাদের উপর কোন প্রভাব ফেলতে পারে না।
যদি কোন কারণে পৃথিবীর এই ঘূর্ণন থেমে যায় বা বেগ বেড়ে যায় তাহলে সাথে সাথে আমরা ছিটকে পড়ে যাব।
কারনঃ ৪
আবার, কোন কিছুর বেগ বুঝতে হলে কোন প্রসঙ্গ কাঠামোর প্রয়োজন, অর্থাৎ আশে পাশের কোন কিছুর সাথে নিজের অবস্থান কে তুলনা করার মত পরিস্থিতি থাকতে হবে। তুলনা করার মত কিছু না থাকলে আপনি বুঝতে পারবেন না যে আপনি গতিশীল নাকি স্থির। যেমন আপনি যখন গাড়িতে ভ্রমণ করেন তখন আশেপাশের গাছপালা বা রাস্তার সাপেক্ষে আপনার অবস্থানের পরিবর্তন দেখে বুঝতে পারবেন যে আপনি গতিশীল।
কিন্তু পৃথিবীর কথা ভেবে দেখুন তো। মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু পরস্পর থেকে এতটাই দূরত্বে অবস্থিত যে আকাশের দিকে তাকিয়ে কোন নক্ষত্র, গ্রহ বা উপগ্রহের সাপেক্ষে আপনার অবস্থানের পরিবর্তন ধরতে পারবেন না। কারণ এতটা সূক্ষ্ম পরিবর্তন খালি চোখে বোঝা অসম্ভব। ফলাফল পৃথিবীকে আপনার কাছে স্থির মনে হবে।
কারনঃ ৫
আগেই বলেছি পৃথিবী সমবেগে গতিশীল। নিজ অক্ষে পৃথিবীর এমন মসৃণ বেগে আমাদের কিছুতেই বুঝতে দেয় না যে আমরাও গতিশীল। আবার পৃথিবীর আকৃতির তুলনায় আমাদের অস্তিত্ব অতি নগণ্য। এতে করে এই ঘূর্ণন আমাদের উপর কোন প্রভাবই ফেলতে পারে না।
মূলত এসব কারণেই আমরা পৃথিবীর ঘূর্ণন বুঝতে পারি না কিংবা পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে ছিটকে পড়ি না। আশা করি বিষয়টি এখন আপনার কাছে পরিষ্কার মনে হচ্ছে।
কমেন্ট বক্সে লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত জানান |
আরও পড়ুন- আলোর প্রতিফলনের মাধ্যমে আমরা কিভাবে কোন বস্তু দেখতে পাই?
আগুন পদার্থ নাকি শক্তি (What Is Fire)?
References
How fast is the earth moving?- scientificamericanWhy Can’t We Feel Earth’s Spin? - earthsky
1 মন্তব্যসমূহ
ধন্যবাদ
উত্তরমুছুনIf it seems any informative mistake in the post, you are cordially welcome to suggest fixing it.