সোনা কেন এত মূল্যবান! |
সোনা কেন এত মূল্যবান?
এখন পর্যন্ত আবিস্কৃত মৌলের সংখ্যা ১১৮ টি। এর মধ্যে ধাতু রয়েছে ৯১ টি। এদের মধ্যে কিছু ধাতু রয়েছে বেশ মূল্যবান, যাদের মধ্যে সোনা বা স্বর্ণ অন্যতম। কিন্তু কেন সোনা এত মূল্যবান? কিভাবেই বা এর মূল্য নির্ধারিত হয়েছে? চলুন জেনে নেওয়া যাক।
সোনা মূল্যবান হওয়ার পেছনে যে সকল কারণ রয়েছে তাদের আমরা প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করতে পারি। আর তা হল-
১। ভৌত বৈশিষ্ট্য
২। রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য
তবে এ দুটি কারণ ছাড়াও আরো কিছু কারণ রয়েছে যা কি না অন্যান্য ধাতুর চেয়ে সোনা কে এগিয়ে রাখে। তবে সে আলোচনায় যাওয়ার আগে আমরা মূল কারণ দুটি নিয়ে আলোচনা করে নেই।
সোনা এত মূল্যবান হওয়ার পেছনে এর ভৌত বৈশিষ্ট্যের প্রভাব।
সোনার ভৌত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হল এর বর্ণ। উজ্জ্বল হলুদ বা সোনালী বর্ণের এই ধাতুটি এতটাই চিত্তাকর্ষক যে সৌন্দর্য বর্ধক হিসেবে অলংকার তৈরিতে শতাব্দির পর শতাব্দি মানুষ সোনাকেই বেছে নিয়েছে। যেকোনো প্রাচীন সভ্যতা ঘাটলে দেখা যাবে সে সব সময়ের শাসক বা রাজা-বাদশারা সোনার তৈরি বিভিন্ন ধরনের অলংকার ব্যবহার করে থাকতেন। যে কারণে প্রাচীন সময় থেকেই অত্যন্ত মূল্যবান ও অভিজাত ধাতু হিসেবে এটি ব্যাবহৃত হয়ে আসছে। অন্যান্য ধাতুর সাথে এ ধাতুটিকে তুলনা করলেই বোঝা যায় এর অনন্যতা। রুপা বা তামার মত ধাতুগুলো অলংকার তৈরিতে ব্যাবহৃত হলেও বর্ণ বা উজ্জ্বলতায় এটির ধারে কাছেও নয়৷ সোনাকে পালিশ করে সহজেই অত্যন্ত চকচকে ও উজ্জ্বল করা যায়, যেখানে অন্যান্য ধাতু চাকচিক্যের দিক দিয়ে সোনার চেয়ে অনেক পিছিয়ে।
সোনা অত্যন্ত নমনীয় একটি ধাতু। এটি এতটাই নমনীয় যে এটিকে খুবই পাতলা পাত কিংবা অত্যন্ত সরু তারে পরিণত করা যায়। আবার এটি একটি ভারী ধাতুও, যার ঘনত্ব 19.3 গ্রাম সেমি-3। ফলে মাত্র এক গ্রাম সোনাকে সোনার পাতলা পাতে পরিণত করা যেতে পারে যা প্রায় এক বর্গমিটার ক্ষেত্রফলের অত্যন্ত পাতলা শীট তৈরি করতে পারে। হ্যা, এতটাই পাতলা হতে পারে যা কিনা মাত্র ২৩০ টি পরমাণুর সমান পুরু।
নমনীয়তার সাথে সাথে এ ধাতু অত্যন্ত বেশ মজবুতও হয়ে থাকে। ফলে যে কোন আকার প্রদানে এ ধাতুর জুড়ি নেই, যেখানে অন্যান্য ধাতুকে এমনটা করা অসম্ভব। এ ধর্মের কারণে সোনাকে দীর্ঘ ও সরু তারে পরিণত করা যায় যা কি না অন্যান্য ধাতুর তুলনায় বহুগুণ বেশি। এক আউন্স সোনার টুকরা কে অনায়াশে হাজার ফুটের সরু তারে রুপান্তর করা যায়। ফলে বিভিন্ন জটিল নকশা ও আকারের অলংকার সহ অভিজাত সাজসরঞ্জাম তৈরিতে সোনাই সবার প্রথম পছন্দ।
সোনার তুলনামূলকভাবে উচ্চ গলনাঙ্ক রয়েছে যা প্রায় 1,064 ডিগ্রি সেলসিয়াস (1,947 ডিগ্রি ফারেনহাইট)। এই উচ্চ গলনাঙ্ক প্রচন্ড তাপেও এর আকার অবিকৃত রাখতে সাহায্য করে। ফলে অনায়াশে অন্যান্য ধাতুর চেয়ে টেকশই ধাতু হিসেবে এটিই মানুষের বেশি নজর কাড়ে।
সোনা মূল্যবান হওয়ার পেছনে এর রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের প্রভাব
আমরা সোনার রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের বিশদ বিবরণে যাওয়ার সাথে সাথে বুঝতে পারব কিভাবে সোনার রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য এই ধাতুকে অনন্য করে তুলেছে। সোনা একটি "Noble Metal" বা "মহৎ ধাতু" হিসাবে বিবেচিত হয়। এটি রাসায়নিকভাবে নিষ্ক্রিয়। অন্যান্য ধাতুর ন্যায় এটি ক্ষয় হয় না। এটি ক্ষয় প্রতিরোধি বিধায় টেকশই ধাতু হিসেবে মানুষের মাঝে ব্যপক সমাদ্রিত হয়ে থাকে এটি।
ক্ষয় প্রতিরোধি হওয়ার পেছনে সোনার রাসায়নিক গঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সোনার পারমানবিক সংখ্যা ৭৯ এবং নিম্নোক্ত ইলেকট্রন বিন্যাস প্রদর্শন করে-
Xe 4f145d106s1
সোনার ইলেকট্রন বিন্যাসের শেষ কক্ষপথে একটি ইলেকট্রন রয়েছে। আপেক্ষিক প্রভাব বিবেচনা করলে দেখা যায় যে এই 6s ইলেক্ট্রনটি প্রচন্ড গতিতে পরিভ্রমণ করে।
সোনার এই 6s ইলেক্ট্রনটি প্রায় 57.7% আলোর গতিতে চলে, ফলে এই দ্রুত 6s ইলেক্ট্রনটি নিউক্লিয়াসের দিকে তুলনামূলক বেশি আকর্ষণ বলে আকৃষ্ট হয় যাকে নিউক্লিয়াস থেকে সহজে আলাদা হয় না। এতে করে সোনার পরমাণু শেষ কক্ষপথে ইলেক্ট্রন আদান প্রদান করে কোন বিক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করতে পারে, অর্থাৎ অনান্য ধাতুর সাথে বিক্রিয়া না করে।
সোনা নতুন যৌগ তৈরি করার জন্য বিক্রিয়া করার পরিবর্তে পারদের সাথে একটি সংমিশ্রণ তৈরি করে। এটি বেশিরভাগ অ্যাসিডের প্রভাব প্রতিরোধী এবং তাই সহজে ক্ষয় হয় না। তবে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড এবং নাইট্রিক অ্যাসিডের 3:1 মিশ্রণ তৈরি করতে পারে, যাকে অ্যাকোয়া রেজিয়া বলা হয়। সুতরাং, সাধারণভাবে বলতে গেলে সোনা একটি উচ্চ প্রতিক্রিয়াশীল যৌগ নয়। এসিড ছাড়াও সোনা অক্সিজেন, হ্যালোজেন ইত্যাদির সাথে সহজে মিলিত হয় না। Aurous (univalent) এবং auric (trivalent) হল দুটি ধরণের যৌগ যা সোনা দ্বারা গঠিত।
সোনা তাপ এবং বিদ্যুতের একটি খুব ভাল পরিবাহী। এর পাতলা তার বৈদ্যুতিক সার্কিট সংযোগে ব্যবহৃত হয়।
সোনা বিদ্যুতের একটি উত্তম পরিবাহী, যা এটিকে ইলেকট্রনিক্স এবং অন্যান্য ব্যবহারের জন্য একটি চমৎকার উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সূক্ষ্ণ ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রপাতি তে উচ্চ পরিবাহিতার ধাতব পদার্থ হিসেবে সোনার ব্যপক ব্যবহার রয়েছে।
অন্যান্য ধাতুর ন্যায় এটি ক্ষয় হয় না। এটি ক্ষয় প্রতিরোধি বিধায় টেকশই ধাতু হিসেবে মানুষের মাঝে ব্যপক সমাদ্রিত হয়ে থাকে এটি।
সোনা গলতে যে তাপমাত্রা প্রয়োজন তা হল প্রায় ১৯৪৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ১০৬৫ সেন্টিগ্রেড। দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য সোনাকে মজবুত করার জন্য এর সাথে অন্যান্য সংকর ধাতু যেমন দস্তা, রূপা এবং তামা যুক্ত করা হয়। ফলে এটি আরো বেশি টেকশই হয়ে থাকে৷
সোনার মূল্যমান বেশি হওয়ার পেছনে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
বহু শতাব্দী ধরে স্বর্ণ একটি অত্যন্ত মূল্যবান ধাতু, এবং এর আকর্ষণ আজও মানুষকে বিমোহিত করে চলেছে। ধাতুটি হাজার হাজার বছর ধরে সম্পদ ও ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রাচীন সভ্যতায়, স্বর্ণ প্রায়শই ধর্মীয় বা আনুষ্ঠানিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হত এবং রাজকীয় এবং ধনী ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। মিশরীয়রা বিশ্বাস করত যে সোনা হল দেবতার চামড়া, যখন অ্যাজটেক এবং ইনকারা এটিকে জটিল গয়না এবং বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক মুখোশ তৈরি করতে ব্যবহার করত। ইতিহাস জুড়ে সোনা বিশ্বের অর্থনীতি গঠনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এটি অনেক দেশে মুদ্রার জন্য একটি মানদন্ড হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং অনেক আর্থিক ব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আজও, অনেক বিনিয়োগকারী স্বর্ণকে একটি নিরাপদ আশ্রয় বিনিয়োগ হিসাবে দেখেন এবং এটি সম্পদ, ক্ষমতা এবং প্রতিপত্তির প্রতীক হিসেবে রয়ে গেছে। সোনার সাথে সৌন্দর্য এবং বিলাসিতাও জড়িত। এটি গয়না এবং ফ্যাশন ও আনুষাঙ্গিক কাজে একটি জনপ্রিয় উপাদান এবং শতাব্দী ধরে জটিল এবং সুন্দর অলংকার তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়েছে। এর উজ্জ্বল চকচকে রুপ ধাতুটিকে একটি অত্যন্ত আকাঙ্খিত উপাদান করে তোলে এবং যেকোনো পোশাক বা সাজসজ্জায় কমনীয়তার ছোঁয়া যোগ করে।
স্বর্ণ হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ ব্যবহার করে আসছে এবং বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক তাৎপর্য রেখেছে। প্রাচীনকালে, সোনা ব্যবহার দেবতাদের সাথে যুক্ত ছিল এবং প্রায়ই মূর্তি এবং মূর্তিগুলির মতো ধর্মীয় বস্তু তৈরিতে ব্যবহৃত হত। এটি ধনী এবং সম্ভ্রান্তশালীদের কাছে গয়না হিসাবে পরিধান করার একটি অন্যতম মাধ্যম ছিল, যা তাদের মর্যাদা এবং সম্পদের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হত। কিছু সংস্কৃতিতে, এমনকি সোনার নিরাময় বৈশিষ্ট্য রয়েছে বলে বিশ্বাস করা হত এবং এটি ঔষধি প্রতিকার তৈরি করতে ব্যবহৃত হত। ভালোবাসা ও স্নেহের প্রতীক হিসেবেও সোনা ব্যবহার করা হয়েছে। সোনার বাগদানের আংটি দেওয়ার প্রথাটি প্রাচীন রোম থেকে শুরু হয়েছিল, যেখানে এটি বিশ্বাস করা হত যে অনামিকার একটি শিরা ছিল যা সরাসরি হৃদয়ে চলে যায়। দম্পতির মধ্যে বন্ধন এবং প্রতিশ্রুতির প্রতীক হিসাবে এসব আংটি তৈরিতে সোনা ব্যবহার করা হত। অনেক সংস্কৃতিতে, স্বর্ণকে মুদ্রার রূপ হিসাবেও ব্যবহার করা হয়। এর বিরলতা এবং স্থায়িত্ব এটিকে একটি মূল্যবান পণ্য করে তোলে এবং এটি বহু শতাব্দী ধরে বাণিজ্যের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এমনকি আজও, সোনা এখনও বিনিয়োগের একটি ফর্ম হিসাবে ব্যবহৃত হয় এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময়ে এটিকে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সামগ্রিকভাবে, সোনার সাংস্কৃতিক তাত্পর্য যুগে যুগে খুঁজে পাওয়া যায় এবং এটি মর্যাদা, সম্পদ, প্রেম এবং এমনকি মুদ্রার প্রতীক। এর আকর্ষণ এবং মূল্য শতাব্দী ধরে মানবতাকে বিমোহিত করেছে এবং আগামী প্রজন্মের জন্য তা অব্যাহত থাকবে।
শেষ কথা
এবার ভেবে দেখুন তো, আর কোন ধাতু আছে যার এতসব বৈশিষ্ট্য আছে? নি:সন্দেহে নেই। আর তাই অন্যান্য ধাতুকে পিছনে ফেলে গুণ ও মূল্যমানের দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে এই ধাতুটি। সোনার চেয়ে যে ধাতুগুলো বেশি মূল্যবান তাদের এত অনূকূল বৈশিষ্ট্য এবং গুনগত তাতপর্য নেই বললেই চলে। আর এসব কারণেই সোনা এত মূল্যবান একটি ধাতু।
0 মন্তব্যসমূহ
If it seems any informative mistake in the post, you are cordially welcome to suggest fixing it.